প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ। সবেমাত্র বৃটিশ শাসনামল থেকে ভারত উপমহাদেশ মুক্তি পেয়েছে। ইংরেজদের দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙ্গালীরা একটু করে বুঝতে সক্ষম হয়েছে শিক্ষা ছাড়া প্রকৃত মুক্তির কোন পথ নেই। বৃটিশরা এদেশের মুক্তিকামী মানুষদের গোলাম করে রেখেছিল, যদি এদেশের মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় উন্নতি লাভ করে তাহলে তাদের গোলামী থেকে বেড় হয়ে আসবে এবং হয়েছিলও তাই। বৃটিশ আমলে ব্রহ্মপূত্র বিধৌত এই জনপদে উচ্চ শিক্ষার জন্য একমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা হলো “যাদুরচর হাই মাদ্রাসা”। পরবর্তীতে অবশ্য সেটাও উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। অত্যন্ত দরিদ্র জনপদ হওয়ায় ব্যাক্তিগতভাবে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মত বিদ্যোৎসাহী পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর। যদি কেউ মাধ্যমিক শিক্ষার কথা চিন্তা করতো তবে ভয়ঙ্কর ব্রহ্মপূত্র নদ পাড়ি দিয়ে পশ্চিমের থানা চিলমারীতে যেতে হতো আর সেটা হাজারে একজনেরও ভাগ্যে জুটতো না। এমন সময়ে তৎকালীন কুড়িগ্রাম মহুকুমা প্রশাসক(এসডিও) জনাব চৌধুরী গওহরুজ্জামান মহোদয় সুদুর রংপুর কালেক্টরেট হতে অত্র রৌমারী থানা পরিদর্শনে আসেন। এলাকায় তখন হাতে গোণা দুই-চারজন ম্যাট্টিক পাস করা মানুষ। জনাব চৌধুরী সাহেব তৎকালে রৌমারী ডাকবাংলোতে (তদানীন্তন ইন্সপেকশন বাংলো) রাত্রি যাপন করেছিলেন, কেননা ভয়াবহ ব্রহ্মপূত্র নদ পাড়ি দিয়ে ফিরে যাওয়া কল্পনাও করা যেতে পারতো না। রাতেই তিনি স্থানীয় গণ্যমান্যদের পরদিন সকালে যে কোন একটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শণের প্রস্তাব দেন। সে সময় উপস্থিত লোকজন চৌধুরী সাহেবকে জানান যে, অত্র থানায় কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই, আছে একটি মাত্র হাই মাদ্রাসা। তিনি পরদিন ঐ হাই মাদ্রাসা পরিদর্শণ করতে চাইলেন। তাঁকে জানানো হলো হাই মাদ্রাসাটি থানা সদর থেকে প্রায় ৫ মাইল দুরে এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা শুধুমাত্র গরুরগাড়ি অথবা ডিঙ্গি নৌকা। তিনি অবাক দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে তাকালেন। উপস্থিত সবাইকে বললেন তবে আর পরিদর্শনে যাওয়ার দরকার নেই, সবাই আসুন আমরা থানা সদরে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করি। তিনি সকলের মুখে আনন্দের হাসি ও উদ্দীপনা অনুভব করলেন। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব ? থানা সদর এলাকায় প্রতিষ্ঠান গড়ার মত জমি কে দিবে? তাৎক্ষণিক সি.ও (সার্কেল অফিসার, থানার প্রধান সিভিল অফিসার বর্তমানে যেমন ইউএনও) সাহেবকে বললেন সরকারি খাস খতিয়ানভূক্ত জমি থানা সদরে আছে কিনা ? বিধি সহায় ছিল, সিও সাহেব সম্মতি দিলেন রৌমারী বাজার সংলগ্ন (বর্তমানে বিদ্যালয় যেখানে দন্ডায়মান) কিছু জমি আছে যেখানে প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। বড় কর্তা যেখানে বলেছেন সেখানে সিও সাহেবের মতো কর্তাকেতো সম্মতি দিতেই হবে। যথারীতি বন্দোবস্ত করার কথা বলে সেদিন চৌধুরী সাহেব চলে গেলেন আর সিও সাহেবের সাথে অত্র এলাকার ঐ যে হাতে গোণা কয়েকজন শিক্ষিত এবং অর্ধ্ব শিক্ষিত মানুষ সর্বোপরি অত্র এলাকার সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই সরকারি খাস জমিতে গড়ে তুললেন আজকের এই প্রতিষ্ঠান। যদিও চৌধুরী সাহেবের আর কোনদিন অত্র এলাকায় আসা হয়নি। তবে এলাকার মানুষ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিদ্যালয়ের নামটি চৌধুরী সাহেবের নামে নামকরণ করতে ভুলেননি। পূর্বে সংক্ষিপ্ত নামে বিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করা হতো বলে কেউ জানতোও না বা জানতে চাইতোও না বিদ্যালয়ের নাম “রৌমারী সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয়” হলো কিভাবে। কিন্তু সুদীর্ঘ সময় পরে বিদ্যালয়টি ২০১৮ সালের ২১ মে তৎকালীন সরকার সরকারিকরণ করলে পুর্ণাঙ্গ নাম ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতায় “ রৌমারী চৌধুরী গওহরুজ্জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়” নামেই নক্ষত্রের মত দাড়িয়ে আছে আজকের এই প্রতিষ্ঠান । চৌধুরী সাহেব একজন সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তাঁর নামে অত্র কুড়িগ্রাম জেলায় জেলাশহরে গওহর পার্ক নামে একটি পার্ক অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। জনাব চৌধুরী গওহরুজ্জামান এর জন্মস্থান বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার কিংবা হবিগঞ্জে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা তাঁর কোন বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায়নি।আফসোস কিছুদিন পূর্বে তাঁর এক কণ্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী নামে একজনের সন্ধান পাওয়া গেলেও দুর্ভাগ্য ,সন্ধান পাওয়ার দুমাস আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। শোনা যায় তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই, তবে সন্তানদের সন্তানাদি সবাই নাকি ইংল্যান্ড প্রবাসী। যিনি এই মহান উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠা করলেন “চৌধুরী গওহরুজ্জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়” তাঁর বংশধররা কেউই এখন পর্যন্ত জানতেই পারলেন না তাঁদের পূর্ব পুরুষের কেউ একজন এমন মহান কীর্তি রেখে গেছেন। অনেক কথাই বলতে হলো যতটুকু জানতে পেরেছি কিন্তু এর মাঝেও আরো কিছু কথা না বললে প্রতিষ্ঠার ইতিহাস হয়তো অপুর্ণ থেকে যাবে। জনাব চৌধুরী সাহেবের অবদান কোনদিনই রৌমারী বাসী ভুলবে না। তবে আরো কিছু মানুষের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় হয়তো ছাত্র-ছাত্রী জুটতো কিন্তু এই ছাত্র-ছাত্রীদের যাঁরা পড়ালেখা শিখাবেন তেমন শিক্ষক পাওয়া ছিল তৎকালে খুবই কঠিন। প্রতিষ্ঠাকালে সিও অফিসে (বর্তমানে ইউএনও অফিস) নিম্ন কোন পদে কর্মরত বগুড়ার মানুষ প্রয়াত তোজাম্মেল হক স্যার যিনি তাঁর নির্ধারিত সরকারি দায়িত্ব পালন করে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ছাত্র পড়ানোর নেশায় পড়ে থাকতেন তখনকার ভাঙ্গাচুরা এই প্রতিষ্ঠানে। এক বছর পর তিনিও বদলিজনিত কারণে রৌমারী ছেড়ে চলে যান। বর্তমানের মত নিয়োগ বিধি-বিধান না থাকলেও তোজাম্মেল স্যারকেই প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে এখনও গণ্য করা হয় এবং প্রতিষ্ঠানের অর্নারবোর্ডে তাঁর নামটি সম্মানের সাথে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে জনাব নজিবর রহমান খোকা মিঞা ( রৌমারী ভিটাবাড়ী নিবাসী মরহুম নায়েব উল্যা মিঞার পূত্র অর্থাৎ আমাদের সকলের পরিচিত মরহুম নুরুল ইসলাম পাপু মিঞার বড় ভাই) কিছুদিনের জন্য বিদ্যালয়টির হাল ধরেন। বিধি বাম তিনিও সরকারী চাকুরিতে (শিক্ষা অফিসার) প্রবেশ করলে মরহুম সাদেক হোসেন (বর্তমানে তাঁর নামে “সাদেক হোসেন মেমোরিয়াল হাই স্কুল” নামে একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে রৌমারীতে) কিছুদিনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরে ছিলেন। তিনিও চলে গেলেন অজানা কোন কারণে। এরপর টাপুরচর নিবাসী মরহুম আব্দুল হাকিম সাহেব বেশ কিছুদিন প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্ম রত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি উলিপুর চলে যান এবং দীর্ঘদিন উলিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমানে উলিপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপরের ইতিহাস বিশাল লম্বা । দীর্ঘ একচল্লিশ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মরহুম আজিজুল হক স্যার। উল্লেখ্য বর্তমানে এই উপজেলায় চল্লিশোর্ধ বয়সের শিক্ষিত মানুষ গুলোর বেশীরভাগই প্রয়াত আজিজুল হক স্যারের ছাত্র। তাঁর অবসর গ্রহণের পর মরহুম আব্দুস ছাত্তার স্যার অল্প সময়ের জন্য বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জনাব আবু হোরায়রা (২০০১ সালের ১মার্চ হতে ২০১৮ সালের ২০মে পর্যন্ত বেসরকারি আমল এবং ২১মে ২০১৮ খ্রিঃ হতে সরকারি আমল) প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন । তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি করে কলেজ সরকারিকরণ করলে ২০১৮ সালের ২১ মে বিদ্যালয়টি সরকারি করণ করা হয় এবং বিদ্যালয়টির পূর্নাঙ্গ নাম ব্যবহার করা হয় “রৌমারী চৌধুরী গওহরুজ্জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়”। আমার জনামতে (প্রাক্তন শিক্ষক মরহুম রোস্তম আলী দেওয়ান, মরহুম আব্দুস ছাত্তার, মরহুম মকবুল হোসেন, মরহুম মোহাম্মদ আলী, মরহুম আবুল হোসেন, মরহুম আব্দুল আজিজ, মরহুম মৌলানা নূরমোহাম্মদ এবং প্রয়াত বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছাইয়েদুর রহমান চেয়ারম্যান ও প্রয়াত আরেকজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ নুরুল ইসলাম পাপু মিঞা প্রমূখের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ) বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরলাম। [কোন অংশ বাদ পড়লে কিংবা সংশোধন করার সুপারিশ থাকলে ওয়েব সাইটে দেখে যদি কেউ আরো তথ্য দিতে পারেন তবে সাদরে গ্রহণ করা হবে।]